Thursday, December 7, 2017

বাবরি মসজিদ বনাম রাম মন্দির,

🌷বাবরি মসজিদ বনাম রাম মন্দির🌷

🌷

ভারতের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত নাম বাবরি মসিজদ। দেশটির উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে ১৫২৮-২৯ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে মসজিদটি তৈরি করেন মীর বাকী। বাবরের নামেই মসজিদটির নামকরণ করা হয় বাবরি মসজিদ। ভারতীয় হিন্দুদের একটি অংশ মনে করে, ওই জায়গাটি হচ্ছে তাদের দেবতা রামের জন্মভূমি। তাদের ধারণা, যেখানে মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে আগে রাম মন্দির ছিল। এ নিয়ে প্রথমে ধর্মীয় বিতর্ক শুরু হলেও পরে তা রাজনৈতিক রূপ পায়।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেয় মৌলবাদী হিন্দুরা। এ নিয়ে ভারতে শুরু হয় সম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এতে নিহত হয় অন্তত ২ হাজার। ভারতের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে হয়েছে মামলা। সেই মামলা নিয়েও হয়েছে বিতর্ক।
সর্বপ্রথম ১৮৫৩ সালে বাবরি মসজিদ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর সময় প্রথমবারের মতো হিন্দুদের একটি অংশ দাবি তোলে, সম্রাট বাবরের সময়ে উত্তরপ্রদেশে রামমন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। সেই থেকে শুরু। পরে ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশরা ভারত শাসনের সময় হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের কারণ ওই জায়গাকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়। একভাগ হিন্দুদের, অন্যভাগ মুসলিমদের দেয়া হয়। এ নিয়ে ১৮৮৫ সালে প্রথম মামলা করেন মহন্ত রঘুবীর দাস নামের একজন। মামলায় মসজিদের বাইরে হিন্দুদের জন্য একটি শামিয়ানা খাটানো ও মঞ্চ তৈরির কথা বলা হয়। তবে সেই মামলা খারিজ করে দেয় ফৈজাবাদ জেলা আদালত।
১৯৪৯ সালে হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের একটি মূর্তি পাওয়া যায় মসজিদের ভেতর। ওই মূর্তি হিন্দুরা গোপনে মসজিদে রেখে এসেছে বলে অভিযোগ করে মুসলিমরা। দুই পক্ষই মসজিদের জায়গা দাবি করতে থাকে। এক পর্যায়ে ওই জায়গা বিতর্কিত ঘোষণা করে তালা ঝুলিয়ে দেয় সরকার।
১৯৫০ সালে গোপাল সিং বিশারদ ও মহন্ত পরমহংস রামচন্দ্র দাস নামের দুইজন ওই স্থানে প্রার্থনা করার জন্য আবারও ফৈজাবাদ আদালতে আবেদন করে। ফলে জায়গাটি খুলে দেয়া হয়। জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হিন্দুদের দেয়ার জন্য ১৯৫৯ সালে আদালতে আবেদন করে তারা। ১৯৬১ সালে ওয়াকফের সুন্নি সেন্ট্রাল বোর্ড মসজিদে হিন্দু দেবতার মূর্তি স্থাপনের বিরুদ্ধে আবেদন করে।
১৯৮৪ সালে মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির গড়তে একটি কমিটি করে হিন্দুরা। তাদের সেই মৌলবাদী আন্দোলনই এক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মঞ্চে আসে ভারতের হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। দলটির নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে শুরু হয় এই আন্দোলন।
১৯৮৬ সাল হরি শঙ্কর দুব নামের এক হিন্দুর আবেদনের ভিত্তিতে জেলা আদালত নির্দেশ দেয় মসজিদের গেট খুলে দেয়ার এবং সেখানে হিন্দুরা প্রার্থনা করার। এর প্রতিবাদ জানায় মুসলিমরা। তারা গঠন করে ‘বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি’। ১৯৮৯ সালে ভারতের আরেক মৌলবাদী সংগঠন ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ (ভিএইচপি) বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। সংগঠনটির সাবেক সহ-সভাপতি বিচারপতি দেবকী নন্দন আগরওয়াল বাবরি মসজিদ অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আবেদন করেন আদালতে। এতে সবগুলো আবেদনই হাইকোর্টে স্থানান্তর করা হয়।
বাবরি মসজিদ হামলা
১৯৯০ সালে ভিএইচপি নেতৃত্বাধীন হিন্দু মৌলবাদীরা মসজিদ ধ্বংসের চেষ্টা করে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে লালকৃষ্ণ আদভঅনি গুজরাট রাজ্যের সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত এক বিতর্কিত রথযাত্রা করে রাম মন্দিরের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন।
এদিকে ১৯৯১ সালে ভারতের প্রধান বিরোধী দলে হয়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি। উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায়ও আসে তারা। তারা মন্দির আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নেন। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয় চরমপন্থি হিন্দুরা। তাদের এই কাজে সমর্থন দেয় শিবসেনা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি। ওই ঘটনায় ভারতজুড়ে শুরু হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এতে প্রাণ হারায় ২ হাজার মানুষ। ঘটনা তদন্তে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও সরকার বিচারপতি এমএস লিবারহানের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে।
২০০১ সালে মসজিদ ধ্বংসের দশ বছর পূর্তিতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় ভারতে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আবারও দাবি করে, অযোধ্যার ওই জমিতে রাম মন্দির তারা তৈরি করবেই। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাটের আবারও হয় দাঙ্গা। নিহত হয় ১ হাজার জন। ওই বছরই গুজরাটের হাইকোর্ট আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেয়, মসজিদের নিচে কোনও মন্দির আছে কিনা।
২০০৩ সালে জরিপ শুরু করে তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়, মসজিদের নিচে একটি মন্দিরের অস্তিত্ব আছে। তবে ওই প্রতিবেদন মানতে অস্বীকার করে মুসলিমরা। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সাত হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় বিচারের কথা বলা হয়। তবে উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকায় লালকৃষ্ণ আদভানির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা যায়নি।
২০০৪ সাল উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। আদালত রায় দেয়, মামলায় আদভানির নামও রাখতে হবে। ২০০৯ সাল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তৈরি লিবারহান কমিশন জুন মাসে রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে ঘটনার জন্য বিজেপি নেতাদের দায়ী করা হয়। এ নিয়ে ভারতের সংসদে হাঙ্গামা হয়।
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিতর্কিত এই মামলায় রায় দেয়। বলা হয়, জমিকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। এক অংশ পাবে হিন্দু মহাসভা, এক অংশ পাবে মুসলমি ওয়াকফ বোর্ড এবং তৃতীয় অংশ যাবে নির্মোহী আখাড়ায়। রায়ের বিরুদ্ধে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে। ২০১১ সালে রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত।
২০১৪ সালে ভারত ক্ষমতায় আসে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। এ সময় থেকে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদ। ভিএইচপি ঘোষণা করে, সারা দেশ থেকে পাথর সংগ্রহ করে রাম মন্দির তৈরি করা হবে। এতে বিজেপি সরকারের সমর্থন আছে বলেও জানায় তারা। কয়েক মাস পরে ২ লরি পাথর বাবরি মসজিদের জমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে বাধা দেয় তৎকালীন উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় থাকা অখিলেশ যাদব সরকার। এভাবে রাম মন্দির তৈরি করা যাবে না বলে তারা জানায়।
২০১৭ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে লালকৃষ্ণ আদভানি ও অন্য হিন্দু নেতাদের নামে চার্জ সরানো যাবে না বলে জানায় ভারতের সুপ্রিমকোর্ট। এ ধরনের সংবেদনশীল মামলা আদালতের বাইরে মেটানোরও পরামর্শ দেয় তারা। ৩০ মে লালকৃষ্ণ আদভাণীসহ বিজেপির অন্য শীর্ষ নেতাদের আগাম জামিন মঞ্জুর করে দেশটির তদন্ত সংস্থা সিবিআই’র বিশেষ আদালত। লখনউতে সিবিআইর ওই আদালত আদভাণী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতী, মুরলী মনোহরসহ মোট ১২ নেতাকে জামিন দেয়।
বারো অভিযুক্ত নেতাকেই পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দেন বিচারক। অভিযুক্তরা অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। তবে সে বিষয়ে এখনো কোনো রায় দেয়নি আদালত। অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের অব্যাহতির আবেদন আদালত মেনে না নিলে তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে শুনানি শুরু হবে।
মামলা অভিযুক্ত বিজেপির শীর্ষ ৩ নেতা: উমা ভারতী, আদভানী ও মুরলি মনোহর
মামলায় অভিযুক্ত অন্য বিজেপি নেতারা হচ্ছেন: বিনয় কাটিয়ার, বিষ্ণুহরি ডালমিয়া, সতীশ প্রধান, সিআর বনশাল, সাধ্বী রীতম্ভরা, আরভি বেদান্তি, জগদীশ মুনি মহারাজ, বিএল শর্মা, নিত্যগোপাল দাস, ধর্ম দাস ও সতীশ নাগার।